মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আছমা আক্তার (৩২) ১২ বছর এবং তার আপন ছোটভাই জাহাঙ্গীর (২৫) দুই বছর যাবত লোহার শিকলে বন্দি।

রাত-দিন রোদ, বৃষ্টি, শীত, গরম সবসময়ই ঘরের বাহিরে শিকলবন্দি থাকেন তারা। ঘরের ভেতরে তাদের শিকলবন্দি করে রাখলে ঘরের বেড়া, দরজা ও জিনিসপত্র ভেঙে ফেলেন। ফলে তাদের পরিবারের লোকজন বাহিরে রাখতে বাধ্য হয়েছেন।

নির্মম এ দৃশ্যটি যে কাউকেই ব্যথিত করবে; কিন্তু জাহাঙ্গীর ও আছমার হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এছাড়া আর কিছুই করার নেই। টাকার অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান দুটির চিকিৎসা করাতে পারছেন না দরিদ্র দিনমজুর পিতা ফজলু মিয়া (৭২)। সন্তান দুটি যাতে হারিয়ে না যায়, সেই কারণে শিকল দিয়ে তাদের বেঁধে রাখার চেষ্টা।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামে দিনমজুর ফজলু মিয়ার চার মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ফজলু মিয়া। বয়সের ভারে এখন মজুরির কাজও করতে পারছেন না তিনি।

প্রতিদিন কাজের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পর কখনো বাড়িতে ফিরে আসেন, নয়তো কখনো অন্যের ঘরে রাত কাটান ফজলু মিয়া। সংসারের দারিদ্র্য ঘোচাতে ১৫ বছর বয়সে আছমা ঢাকায় এক পোশাক কারখানায় চাকরি নেন।

সংসারে মা-বাবাকে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা জমাও রাখতেন একজনের কাছে। দীর্ঘ পাঁচ বছরে বেশ টাকা জমা হয়। হঠাৎ করেই জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় লোকটি। এরপর আছমা চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীর শ্রমিকের কাজ ও ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। মানসিক ভারসাম্যহীন বড়বোন আছমা আক্তার ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর, মা ফজিলা বেগমকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত ও ছোটভাই জাহাঙ্গীরকে মারপিট করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জাহাঙ্গীর একসময় বোন আছমা আক্তারকে মারপিট করে।

এ ঘটনার পর থেকে জাহাঙ্গীরও আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বয়সের ভারে মা ফজিলা খাতুন ঠিকমতো চোখে দেখেন না। দরিদ্র দিনমজুর বাবা ফজলু মিয়ার পক্ষে মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। তাদের পাগলামির মাত্রা বেড়ে গেলে পায়ে শিকল পেঁচিয়ে তালা মেরে বেঁধে রাখেন। এভাবেই চলছে তাদের রাত-দিন ও বছরের পর বছর।

দিনমজুর ফজলু মিয়ার অভাবের সংসার। ছোট একটি ভাঙা ঘরে একটি চৌকি ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যাবে গাছের সঙ্গে জাহাঙ্গীরকে আর আছমাকে সিমেন্টের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। মানুষ দেখলেই তারা শিকল দেখিয়ে খুলে দেওয়ার ইশারা করেন।

জাহাঙ্গীর ও আছমা খাতুনের মা ফজিলা খাতুন যুগান্তরকে জানান, তারা ঘরের মালপত্র, খাবার ও অন্যের বাড়ির মালামাল নষ্ট করে ফেলে। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে এবং হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে শিকল দিয়ে তাদের বেঁধে রেখেছি। টাকার অভাবে তাদের মুখে খাবারই দিতে পারি না, চিকিৎসা করাব কীভাবে।

কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা হচ্ছে না। তাই ভাই-বোন শিকলে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি উপজেলা পরিষদ ও ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব।

কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. আকতারুন নেছা জানান, বিষয়টি জানতে পেরেছি। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে দেখব কীভাবে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।

#যুগান্তর